শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে শঙ্কা

চলতি বছর থেকে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলামে পড়ালেখা শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ক্লাসেও একই কারিকুলাম চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তারই অংশ হিসেবে আগামী বছর ৩য়, ৪র্থ, ৮ম এবং নবম শ্রেণিতে, ২০২৫ সালে ৫ম ও দশম শ্রেণিতে যুক্ত হবে নতুন কারিকুলাম। ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সাল থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতেও নতুন কারিকুলামে পাঠদানের পরিকল্পনা রয়েছে।

তবে নতুন শিক্ষা কারিকুলামে প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অভিভাবকরা। তাদের অভিযোগ, শিক্ষার্থীরা পড়ার অভ্যাস হারিয়ে ফেলছে। আগে সন্ধ্যার পর পড়তে বসতো, এখন সেটা নেই। এখন সন্তান সন্ধ্যার পর মোবাইল, কম্পিউটার, ট্যাব নিয়ে এসাইনমেন্ট করতে বসছে। এসাইনমেন্ট করার জন্য বসলেও সে ফেসবুক, ইউটিউবে চলে যাচ্ছে। গান, সিনেমা, কার্টূনে আসক্ত হয়ে পড়ছে। অভিভাবকরা মনে করছে, প্রযুক্তির অত্যাধিক ব্যবহার সন্তানকে মানসিক সমস্যায় ফেলছে। শিশুদের ‘ফাঁকিবাজ’ হিসেবেও তৈরী করছে।

নতুন কারিকুলাম সম্পর্কে যথাযথ অভিজ্ঞতা না থাকায় শিক্ষকরাও আছেন বিভ্রান্তিতে। একেক প্রতিষ্ঠানে একেকভাবে চলছে মূল্যায়ন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নতুন কারিকুলামের প্র্যাক্টিকাল ভিডিও নিয়ে হাস্যরস তৈরি হয়েছে। নতুন কারিকুলাম সম্পর্কে অভিভাকদের ধারণা না থাকায় শিক্ষার্থীদের গাইড করতেও হিমশিম খাচ্ছেন। সন্তান বাসায় এসে যা বলছে তাই বিশ্বাস করতে হচ্ছে।

এ নিয়ে কয়েক ধাপে সভা, সেমিনার ও মানববন্ধন করেছেন এক শ্রেণির শিক্ষক ও অভিভাবকরা। নতুন শিক্ষা কারিকুলাম ও পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিলসহ ৮ দফা দাবি জানিয়ে আন্দোলন করছে ‘সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন’ ও ‘সচেতন অভিভাবক সমাজ’ সহ ফেসবুকভিত্তিক কয়েকটি সংগঠন।

সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন নামে সংগঠনটির আহ্বায়ক রাখাল রাহা বলেন, একটি কারিকুলাম প্রণয়নে বিভিন্ন মহলে আলোচনা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী কি না সেটি ভাবার প্রয়োজন ছিল। সংসদে ও মন্ত্রিপরিষদে এ কারিকুলামে আলোচনা হওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এসব হয়েছে কি না আমরা জানি না। যদি হতো তাহলে এমন কারিকুলাম প্রণয়ন করা হতো না। আমাদের আহ্বান থাকবে অবিলম্বে আমাদের শিক্ষার্থী ও জাতি ধ্বংসের এই কারিকুলামের প্রকল্প বন্ধ করুন। দেশের পরবর্তী প্রজন্মকে বাঁচাতে হলে এ কারিকুলাম বন্ধ করার বিকল্প নেই।

আইনুন নাহার নামে এক অভিভাবকের দুই মেয়ে ভিকারুন্নেসা নুন স্কুলে পড়েন। বাংলা, ইংরেজি, অংক, ধর্ম শিক্ষা- এই ৪টি বিষয় প্র্যাক্টিকাল শেখার জিনিস নয়। আমরা চাই অন্তত এই চার বিষয়ে পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা হোক। নতুন কারিকুলামে যেভাবে শিক্ষার্থীদের ডিভাইস নির্ভর করা হয়েছে আমরা সেটি নিয়ে শঙ্কিত। নতুন কারিকুলামে অনেক অশ্লীল বিষয় রয়েছে সেগুলো বাদ দেয়া হোক। আমার এক মেয়ে পড়ে দশম শ্রেণিতে সে সন্ধ্যার পর পড়তে বসে, অন্য মেয়ে পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে কিন্তু তার কোনো পড়া নেই।

তিনি আরও বলেন, বাংলা ও ইংরেজিতে গ্রামার নেই। গ্রামার না থাকলে বেসিক জ্ঞান তারা কিভাবে পাবে। বই খুলে মেয়েকে পড়াতে গিয়ে লজ্জা পাই। আমার মেয়ের পড়ার অভ্যাস হারিয়ে ফেলছে। এভাবে আমাদের সন্তানদের পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে।

উদয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, ডিভাইস নির্ভর শিক্ষা আমরা চাই না। আমরা চাই না আমাদের সন্তান গুগল নির্ভর হয়ে পড়ুক। গুগল, ইউটিউব দেখে লিখে লিখে তারা কি শিখবে? আমরা সরকারের কাছে কোনো দাবি জানালে তারা এটাকে গাইড ও কোচিং ব্যবসায়ীদের ষড়যন্ত্র বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। এই গাইড পড়ে, কোচিং করে আগেকার শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স পেয়েছে।

বাংলাবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, আমাদের বাচ্চারা দেশের বাইরে পড়তে গেলে এই শিক্ষা তাদের কাটা হয়ে দাঁড়াবে। তারা কিভাবে এটার সাথে খাপ খাওয়াবে। আগে বিশেষজ্ঞরা বলতো, ১৬ বছর বয়সের আগে একটা বাচ্চাকে যাতে ডিভাইস না দেয়া হয়। মোবাইলের ইফেক্ট বাচ্চাদের ব্রেইনে সমস্যা করছে, তাদের আচরণ পরিবর্তণ এসে যাচ্ছে। কিন্তু এখন শিক্ষার নামে তাদের হাতে মোবাইল, ট্যাব ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমরা কতক্ষণ তাদের গার্ড দিয়ে রাখবো। তাদের বিপথে যাওয়ার সুযোগ আরও বেশি তৈরি হলো।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নুর মোহাম্মদ বলেন, এক জেনারেশন থেকে অন্য জেনারেশনের একটা গ্যাপ থাকে। সেটা অনেক সময় অভিভাবকরা মেনে নিতে পারে না। তাদের উচিত সন্তানদের প্লেস দেয়া। নতুন বিশ্বের সাথে খাপ খাওয়াতে হলে সন্তানদের নতুন জিনিস শেখার সুযোগ করে দিতে হবে। শিশুদের ডিভাইস ব্যবহারের বিষয়ে একটি নির্দিষ্ট সময় দিতে হবে। তাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে হবে। প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে তাদেরকে বাইরে খেলতে নিয়ে যেতে হবে। সবকিছুর একটি নিদিষ্ট টাইম ফ্রেম থাকলে শিশুরা ডিভাইসে আসক্ত হবে না।

তিনি আরও বলেন, আমাদের স্কুল-কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। সাইকোলজি সেন্টারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মানসিক পর্যবেক্ষণে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর পরিবার ও সন্তানের সাথে এসেসমেন্ট করলে শিশুরা আসক্তি বা মানসিক বিপর্যয়ে পড়বে না।